নেপোলিয়নের পতন হলো যেভাবে। War of Attrition!

 নেপোলিয়ন যখন অবশেষে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে প্রবেশ করলেন, তখন দেখলেন পুরো শহরই পরিত্যক্ত। কোথাও টুঁ শব্দ নেই। জনমানবশূন্য এক ভৌতিক নগরী যেন। বড় বড় সুদৃশ্য বাড়িগুলো আগুনে পুড়ছে। পুরো শহরই ঢাকা তার ধোঁয়ায়। দোকানগুলোতে পণ্য নেই, গুদামে খাবার নেই। পুরো শহরজুড়ে নেপোলিয়নের সঙ্গী কেবল রাশিয়ান ঠান্ডা আর তুষারপাত। 


নেপোলিয়নকে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে না নামতে। “শুন রে নেপোলিয়ন। সে বিশাল দেশ, মাইলের পর মাইল জনমানবহীন প্রান্তর, রুক্ষ সমভূমি। আমাদের মূল্যবান সেনাকে ওই অভিশপ্ত দেশে নিয়ে গিয়ে বলি দিস না!”


নেপোলিয়ন শুনেননি। তখন তিনি অজেয়, অধরা। 


-“পশ্চিমে ব্রিটেন প্রায় কবজা হয়ে এলো বলে। এবার নাহয় পূর্বে তাকানো যাক! রাশিয়ার এতো ঔদ্ধত্য কি করে হয়? ঐ বুড়ো আলেক্সান্ডার! ওর এতো তেজ, যে কিনা আমাকে, এই নেপোলিয়ন দি গ্রেটকে হুমকি দেয়? ওর ধ্বংস দেখবো আমি! ওর শেষ দেখে ছাড়বো আমি!”


হ্যাঁ শেষ নেপোলিয়ন দেখেছিলেন। তবে রাশিয়ান সম্রাট আলেক্সান্ডারের নয়। শেষ দেখেছিলেন নিজের। দুর্গম রাশিয়া পার হয়ে যখন নিজ দেশে ফিরে এলেন, তখন নেপোলিয়নের চেহারায় আর ক্ষাত্রতেজ ছিলোনা, বরং লজ্জায় নুয়ে আসছিলো সেই গর্বিত মুখ!


রাশিয়ার সাথে সুন্দর একটি চুক্তি করেছিলো ফ্রান্স। টিলসিটের চুক্তি। কিছুদিন চলেও ছিলো ভাই ভাই সম্পর্ক। কিন্তু ধীরে ধীরে বেঁকে বসে রাশিয়া। নেপোলিয়নের আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কার হতে থাকে তাদের সামনে। একে একে বিদেশী শক্তিগুলোকে হয় ছলে নয় বলে কবজা করে পুরো ইউরোপেরই সম্রাট হওয়ার ধান্দায় আছেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট!


সুতরাং রাশিয়া সরে দাঁড়ালো। আর পেলো সরাসরি নেপোলিয়নের কাছ থেকে যুদ্ধের হুমকি!


নানা দেশের প্রায় ছয় লক্ষ সেনা নিয়ে রাশিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন নেপোলিয়ন। হায়! তখন কি ভেবেছিলেন এই লোভের ফল কী হতে পারে?


ঈশ্বর কিন্তু সংকেত দিয়েছিলেন। স্মোলেন্সকের যুদ্ধে। 


রাশিয়ার সীমানায় প্রবেশের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মাথায় প্রচণ্ড রোদ, উদয়াস্ত হাঁটা, খাবারের অভাব আর টাইফাস, আমাশয়ের মত রোগে অর্ধেক সেনাকেই হারিয়ে ফেললেন নেপোলিয়ন। কিন্তু সেই সংকেত আমলে নিলেননা। স্মোলেন্সকের প্রান্তরে ভয়াবহ যুদ্ধে অনেক কষ্টে বিজয়ী হলেন। রাশিয়ান সেনারা পিছু হটে গেলো! তাদের তাড়া করলেন নেপোলিয়ন। 


-“ওরে নেপোলিয়ন, তুই রাশিয়ানদের তাড়া করিসনা। তারা তোকে লোভে ফেলছে। যতই সামনে যাবি তত শক্তিক্ষয় হবে। এ হলো সেই রামায়ণের মায়াবী স্বর্ণমৃগ!”


কে শোনে কার কথা! মস্কো থেকে মাত্র সত্তর মাইল দূরে রাশিয়ানদের সাথে ফের মোলাকাত হলো নেপোলিয়নের। বোরোদিনোর সেই যুদ্ধে আবারো একটুর জন্য জিতলেন নেপোলিয়ন। কিংবা বলা চলে রাশিয়ানরা জিতিয়ে দিলো তাকে। হেরে আবার পৃষ্ঠটান দিলো রাশিয়ানরা। আর যাওয়ার পথে ধ্বংস করে দিয়ে গেলো জলের কুয়া, পুকুর, ধান গমের গোলা, গুদামঘর, দোকানপাট সহ সবকিছু। যাতে ফরাসী সেনারা সামনে এগিয়ে ক্ষুধাতৃষ্ণায় ভুগতে থাকে!


এর নাম War of Attrition! নেপোলিয়নের আসন্ন যম।


নেপোলিয়ন ছুটলেন মস্কোতে। ততদিনে রোগে দুর্ভোগে কঠিন আবহাওয়ায় তার পাঁচ ভাগের চার ভাগ সেনাই মারা গিয়েছে।


“নেপোলিয়ন, মস্কোতে ঢুকিসনা। ওরা নিজেরাই মস্কোকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। সে এখন মৃত্যুপুরী। ইঁদুর ধরার কল! লোভ ত্যাগ করে ফিরে আয় শ্যামল সবুজ ফ্রান্সে!”


নেপোলিয়ন ফিরেননি। লোভে অন্ধ ফরাসীরা প্রবেশ করলো মস্কোতে। রাশিয়া তো জয় হলো! কিন্তু একি! এতো ধ্বংসপ্রায় এক পরিত্যক্ত ভুতুড়ে নগরী।


এত কিছুর পরও নেপোলিয়ন পাঁচ সপ্তাহ অপেক্ষা করলেন মস্কোতে। আশা - রাশিয়ানরা সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে আসবে! কিন্তু হায়! সেই প্রস্তাব আসেনি। 


অবশেষে চোখ খুললো তাঁর! পালাতে শুরু করলেন ফ্রান্সের দিকে! কিন্তু তাও কি এত সহজে হয়! শীতকাল চলে এসেছে যে! প্রচন্ড ঠান্ডা, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর তুষারপাত, তার ওপর খাবারের অভাব, সুপেয় জলের অভাব। ময়লা কাপড়চোপড়ে উকুন আর ছাড়পোকা বাসা বেঁধেছে। টাইফাসে শয়ে শয়ে সেনা মরতে লাগলো। নোংরা তাঁবুতে সহজেই ছড়িয়ে পড়লো ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা। এর বাইরে রাশিয়ানদের গেরিলা আক্রমণ তো আছেই!


অবশেষে লোভী নেপোলিয়ন যখন রিক্তহস্তে স্বদেশে ফিরলেন, তখন পিছনে রেখে এসেছেন হাজার হাজার তরুণের লাশ, তাঁর নিজের লোভের সাক্ষী হিসেবে!


পৃথিবীতে যুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম ব্লান্ডার ধরা হয় নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণকে। এত এত সুবুদ্ধি পাওয়ার পরও কেবলমাত্র রাশিয়া দখল করে ইউরোপের সম্রাট হওয়ার লোভই শেষ করলো নেপোলিয়নকে।


ব্যাকরণের বইয়ের প্রবাদ প্রবচন চাপ্টারে তো আর এমনি এমনি বলেনি… 


“লোভে পাপ পাপে মৃত্যু!”


- শত্রুঘ্ন অর্পিত

No comments:

Post a Comment

কথিত জঙ্গিদমনের আড়ালে মিলিয়ন ডলার সিন্ডিকে

⚠️ জঙ্গিদমনের আড়ালে মিলিয়ন ডলার সিন্ডিকেট  সিটিটিসি-র‍্যাব-এটিউ এর কথিত জঙ্গি-বিরোধী লড়াই যতটুকু না আদর্শিক, তার চেয়েও বেশি রিজিকের লড়াই। কথ...