ভয়েজার মিশনঃ- এক অভিমানী স্পেসপ্রোবের গল্পঃ
মানব সভ্যতার শুরুতে একজন আদি মানব আকাশে তাকিয়ে বলেছিলেন, কী আছে মেঘের ওপারে?.তারা খালি চোখে আকাশ দেখে অন্ধকার আকাশের মিটমিট আলো গুলোকে বিভিন্নভাবে চিন্তা করতো।পৃথিবীতে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার সূচনা হয় সেই তিন শতাব্দী আগে। টেলিস্কোপ আবিষ্কার করে টেলিস্কোপ যুগের সূচনা করেছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। ফলে বিজ্ঞানীরা নতুনভাবে আকাশ দেখতে সক্ষম হলেন।এরপর আসলো আরো উন্নত টেলিস্কোপ।
কিন্তু সমস্যা হলো এসব টেলিস্কোপ দিয়ে কোন গ্রহকে ভালোভাবে অবজার্ব করা যায় না। যার ফলে মানুষের প্রয়োজন পড়ে প্রোব বা রোবোটিক স্পেসক্রফটের।মেঘের ওপারে কী আছে সে আমাদের জানা হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে সূর্যের সীমা ছাড়িয়ে দূর মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন গত শতাব্দীর মাঝামাঝিও কেউ দেখতে সাহস পেত না হয়তো। কিন্তু আমরা সে সাফল্যই অর্জন করেছি ভয়েজার মিশনের মাধ্যমে।
♦ভয়েজার ওয়ান এবং ভয়েজার টু- এই দুটো যান মহাকাশে পাঠানো হয়েছিলো ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। ভয়েজার ১ উৎক্ষেপন করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের কেপ ক্যানাভেরাল এয়ার ফোর্স স্টেশন থেকে। ব্যাবহৃত রকেটটি ছিল একটি Titan IIIE।৬০ এর দশকে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বুধ, শুক্র ও মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণের জন্য একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয়। এর অংশ হিসেবে ভয়েজার-১ ও ২ নভোযান দুটি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। মহাকাশযানটির যাত্রার শুরুর দিকে পযের্বক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন নাসার ৩০০ বিজ্ঞানী। এরপর ২০০৪ সালের আগেই এর গতিবিধির দায়িত্বে রাখা হয়েছে মাত্র ১০ জন বিজ্ঞানীকে। কারণ ভয়েজারের এখন আর কোনো বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা নেই।ভয়েজারের এর আকৃতি অনেকটা UFO এর মতো। উপরে আছে একটি বড় অ্যান্টেনা। একপাশে ক্যামেরা এবং অন্যপাশে শক্তি উৎপাদনকারি জেনারেটর যা তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম থেকে শক্তি উৎপাদন করে। তারার অবস্থান এবং মহাজাগতিক রশ্মি চিহ্নিত করার জন্য এতে কিছু সেন্সর রয়েছে তবে তা খুবই পুরনো প্রযুক্তির।
♦২০১২ সালের ২৫ আগস্ট হেলিওপজ পেরিয়ে মানব নির্মিত প্রথম কোনো বস্তু পেরিয়ে যায় সৌরজগতের সীমা। এ অর্জন অবশ্যই অসামান্য।মহাকাশযানের অভিমুখ নিয়ন্ত্রণের জন্য থাকা জাইরোস্কপিক সিস্টেমও তখন আর কাজ করবে না। তথ্য সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণের সিস্টেমও বন্ধ হয়ে যাবে।তারপর উর্ট মেঘের মধ্য দিয়ে নিঃসঙ্গ যাত্রা। এ যাত্রা চলবে হয়তো টানা ৪০ হাজার বছর। ৪০ হাজার বছর পরে গিয়ে ভয়েজার ১ পৌঁছাবে গোলিয়াথ ৪৪৫ নক্ষত্রের কয়েক আলোকবর্ষের মধ্যে।বিজ্ঞানীদের এক হিসাব মতে মহাকাশের ওই সুদূরের ৫-১০% আলোকিত আর ৯০-৯৫% জায়গা অন্ধকার। তাই বলা হচ্ছে, ভয়েজার-১ এখন চলছে মহাকাশের সেই নিঃসীম অন্ধকারের মধ্যে।ভয়েজার-২ ৪০০০০মাইল/ঘণ্টা বেগে চলমান থাকলে তা পৃথিবী হতে উজ্জ্বলতম তারা সিরিয়াস এ পৌছাবে। আরেকটি আগ্রহপূর্ণ ব্যাপার হল মহাকাশযানগুলতে ছিল এলিয়েনদের সামনে মানবজাতিকে তুলে ধরার পদক্ষেপ।কারণ মহাকাশযান গুলোতে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা,ছবি রেকর্ড করে একটি গোল্ডেন রেকর্ড রয়েছে।
♦ভয়েজার ১ নামের রোবট মহাকাশযানটি সূর্যের সীমা ছাড়িয়েই এখন ছুটে চলেছে অনন্ত নক্ষত্রবীথির পানে। ২০২২ সালের যাত্রার ৪৬ বছর পূর্ণ করা এই মহাকাশযানকে বলা যায়।১৯৭৭ সালে যখন যাত্রা শুরু করে, তখন ভয়েজার মিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৃহস্পতি ও শনি গ্রহে অভিযান করা। কিন্তু এই মিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিজ্ঞানীরা আরও বেশি কিছু চিন্তা করলেন। মিশন শেষ করে আশি সালে ভয়েজার ১ মহাশূন্যের পথে যাত্রা করলেও ভয়েজার ২-এর যাত্রাপথ রিপ্রোগ্রাম করে কিছুটা বদলে দিলেন। ফলে ভয়েজার ২ ইউরেনাস ও নেপচুনের গ্রহের পথে অভিযানে এগিয়ে চলল। ভয়েজার ২ যখন পাঠানো হয়, তখন এমনভাবে তা পাঠানো হয়েছিল, যাতে পরবর্তী সময়ে চাইলে ইউরেনাস ও নেপচুন যোগ করা যায় এর যাত্রাপথে। ১৬ দিন পরে পাঠানো ভয়েজার ১-এর গতিপথ ছিল সে হিসেবে কিছুটা ছোট। বৃহস্পতিতে তাই ভয়েজার কিছুদিন আগে ১৯৭৯ সালের ৫ মার্চ পৌঁছে যায়।
বৃহস্পতির মাত্র কয়েক লাখ কিলোমিটার ওপর দিয়ে উড়ে যায় ভয়েজার ১। ভয়েজার ১-এর পাঠানো ছবি থেকে জানা যায় বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে বয়ে চলা বিশাল বিশাল ঝড়ের কথা।১৯৮৬ সালের ২৪ জানুয়ারি, ভয়েজার ২ উড়ে যায় ইউরেনাসের ওপর দিয়ে। মাত্র ৮০১,৫০০ কিলোমিটার দূর থেকে। ইউরেনাসের ঘূর্ণন অন্য গ্রহগুলো থেকে একটু ব্যতিক্রমধর্মী।১৯৮০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়েজার ১-এর পৌঁছানো পর্যন্ত। ভয়েজার ১ পৌঁছে প্রথমবারের মতো পৃথিবীতে পাঠায় শনির বলয়ের হাই রেজুলেশন ছবি।ভয়েজার ১-এর ৯ মাস পরে ২৫ আগস্ট ১৯৮১ সালে শনির কাছে পৌঁছায় ভয়েজার ২ মহাকাশযান। শনি গ্রহের মাত্র ৪১ হাজার কিলোমিটার দূর দিয়ে উড়ে যাওয়া ভয়েজার ২-এর পর্যবেক্ষণে জানা যায় আরও সব চমকপ্রদ তথ্য।নেপচুনের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ভয়েজার ২ আবিষ্কার করে যে সৌরজগতের যেকোনো জায়গার তুলনায় নেপচুনের বায়ুর গতি বেশি, বৃহস্পতি গ্রহের তুলনায় তাঅন্তত তিনগুণ বেশি।বছরের পর বছর সৌরজগতের এমন অনেক অজানা রহস্যের সন্ধান দিতে দিতে মহাকাশযানটি একসময় পৌঁছে যায় সৌরজগতের শেষ প্রান্তে।সৌরজগতের বাইরের এই জগৎ হচ্ছে একটি তারা থেকে আরেকটি তারার মাঝথানের জগৎ, যাকে বলে 'ইন্টারস্টেলার স্পেস'। ঠান্ডা, অন্ধকার এবং মানব অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বাইরের এক জগৎ। এখানে নভোযানটির ওপর সূর্যের প্রভাবের চেয়ে মহাজাগতিক অন্য প্রভাব বেশি কাজ করছে।
♦ভয়েজার ১ বর্তমানে পৃথিবী থেকে সাড়ে ২৪.৫ বিলিয়ন কিলোমিটার বা 156 AU দূরত্বে অবস্থান করছে এ নভোযানটি।অপরদিকে ভয়েজার-২ তুলনামূলক কম তবে ১৯ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল এবং ৪র্থ মহাকাশযান হিসেবে সৌরজগৎ অতিক্রম করার মতো গতিবেগ অর্জন করেছে। এই দূরত্ব এতই বেশি যে এদের পাঠানো সংকেত সংগ্রহে প্রয়োজন নাসার Deep Space Network।ভয়েজার-১ বর্তমান যে স্থানে রয়েছে সেখান থেকে আলো আসতে ২৩.৩ ঘন্টা সময় লাগে।মানে আপনি আলোর গতিতে গেলেও সেখানে ২৩ ঘন্টা সময় লাগবে।ভয়েজার ১ এখনো প্রায় ঘন্টায় ৬০ হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটছে।
লেখকঃ- আহমেদ ইমতিয়াজ সোহেল
শিক্ষার্থী,এরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি
ডিপার্টমেন্ট অব এস্ট্রনমি এবং প্ল্যানাটারি সাইন্স
No comments:
Post a Comment