১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ বদ্ধিজীবীদের করা হত্যা করেছিল?

 বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে আমি সাত ভাগে ভাগ করি। যে কোন ক্যাওসে সুযোগসন্ধানী লোকদের চান্স নেয়ার উদাহরণ অবশ্যই থাকে। 


মার্চে পাকিস্তান আর্মির চালানো গণহত্যায় বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যু হয়েছে, তারা মারা পড়ছেন জেনারেল গণহত্যার ভেতরে, আলাদা প্ল্যান ছিলো না। যুদ্ধের মাঝে এমনকি যুদ্ধের পরেও সিরাজ শিকদারের সর্বহারা বাহিনী শ্রেণীশত্রু মেরেছে, সেখানে অনেক বুদ্ধিজীবী ছিলেন। 


উল্টোদিলে মুজিব বাহিনীও চীনপন্থীদের মেরেছে, তাজউদ্দিন আহমেদ কে হত্যা করতে পাঠানো তাদের এজেন্ট স্বয়ং তাজউদ্দিনের কাছে এসে আত্মসমর্পণ করেছে বলে মূলধারা একাত্তরে খুঁজে পাবেন। পুরো নয় মাসে বাঙালি আর বিহারি পরস্পরের উপর চালানো গনহত্যায় উভয় পক্ষের কবি-বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যু ঘটেছে। আবার ১৬ ডিসেম্বরের পর কালচারের সাথে যুক্ত বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষকে পাকিস্তানপন্থী তকমা দিয়ে মেরে ফেলা হয়ে থাকতে পারে, যেমন খান আতাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলো, এসব ঘটনায় মুজিব বাহিনী বা ভারতীয় বাহিনীর যুক্ত থাকার চান্স থেকে যায়।


আবার স্বাধীনতার পর জহির রায়হানের বিষয়টা অনেক গবেষক স্বাধীনতার পর মিরপুরের অপারেশনের সাথে যুক্ত করার কথা বললেও শাহরিয়ার কবির এবং জহির রায়হানের ছোট বোন মোটামুটি নিশ্চিতভাবে জানাচ্ছেন এটা আওয়ামী লীগের কাজ। তাকে ফোন করে কে নিয়ে গেলো এই প্রশ্নের মীমাংসা কেউ করতে পারেন নাই। জহির রায়হান আওয়ামী লীগের নেতাদের ভারতের কাজ কারবার ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন আবার জহিরের মৃত্যুর পর তার তদন্তের বিষয়ে শেখ মুজিবের কাছে দাবী করা হলে তিনি স্পষ্টভাবে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন- এইসব নথিবদ্ধ তথ্য এই ঘটনার সাথে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের জড়িত থাকার বিষয় ভালভাবেই প্রকাশ করে।


কিন্তু ডিসেম্বরের মোটামুটি ১০ থেকে ১৫ তারিখ শিক্ষক-সাংবাদিক-কবিদের হত্যাকাণ্ডের ঐ ঘটনা মোটামুটি সব এঙ্গেল থেকেই বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাজ। পাকিস্তান আর্মির শীর্ষ অন্তত তিনজন কর্মকর্তা এই ঘটনায় পরস্পরকে দোষারোপ করলেও তারা স্বীকার করেছে এটা পাকিস্তান আর্মিই করেছে। এমন কি জামাতের আমীর গোলাম আজম নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তান আর্মিকেই দিয়েছে। 


বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় জেনারেল নিয়াজি দিয়েছেন জেনারেল রাও ফরমানের ঘাড়ে, নিজের বইতে পরিষ্কার বলেছেন গণহত্যার পরিকল্পনার দায় ফরমান এড়াতে পারেন না। 


পাকিস্তান সরকার জেনারেল নিয়াজিকে একাত্তরের যুদ্ধের পর চাকরি থেকে বহিস্কার এবং পেনশন থেকে বিচ্যুত করলেও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে পাকিস্তান সরকার সম্মানের সাথেই বহাল রাখে চাকরিতে। তাকে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ "ফৌজি ফাউন্ডেশন"-এর ডিরেক্টর করা হয় তাকে। পাক্কা দশ বছর পাকিস্তানের সবচাইতে বড় এই সামরিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিল এই ফরমান আলী।


ল্যাফট্যানেন্ট জেনারেল নিয়াজি মনে করেন আর সব অফিসারদের বাদ দিয়ে ফরমানের ওপরেই কেন পাকিস্তান সরকারের ভালোবাসার অন্যতম একটা কারণ হইল "বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড..."


এজন্যই অন্য অফিসারদের চাকরীচ্যুত করা হলেও জেনারেল ফরমানের জন্য ছিলো অনেক অনেক পুরস্কার।


এদিকে রাও ফরমান বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় দিয়েছেন নিয়াজির কাঁধে, বলেছেন আমি বেসামরিক প্রশাসক ছিলাম, খুন খারাবির কাজে আমি ছিলাম না, তবে নিয়াজির অফিসের সামনে সাদা মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে থাকতে আমি দেখেছি, শুনেছি একটা স্পেশাল কারাগারে ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এনে রাখা হয়।


পাকিস্তানের বেশ পুরাতন এক আমলা আলতাফ গওহর তার এক বাঙালি কবি বন্ধুকে বাঁচানোর সুপারিশ করেছিলেন ফরমানের কাছে, রাও ফরমান আলী নিজের ডায়েরি থেকে সেই কবির নাম কেটে দেন। উনি ছিলেন বাঙালি কবি সানাউল হক। এই তথ্য আপনি পাবেন নিয়াজির সাক্ষাৎকারে।


গোলাম আজমও এক সাক্ষাৎকারে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে দাবী করেছেন তিনিও ফরমানের ডায়েরি থেকে বিভিন্ন মানুষের নাম কাটানো জন্য সুপারিশ করতেন।


পাকিস্তান জামাতে ইসলামের সেলিম মনসুর খালেদ ওনার পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে লেখা 'আল বদর' বইতে লিখেছেন একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ছাত্র সংঘের নাজিম (প্রধান) মুজাহিদ মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আলবদরের সদর দপ্তরে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে ‘আখেরি খিতাব’ (শেষ বক্তৃতা) দেন। বক্তব্যে তিনি দিনটিকে ‘বেদনাদায়ক দিন’ হিসেবে উল্লেখ করেন। পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণকে বলেন ‘ট্র্যাজেডি’। সেদিন মুজাহিদ আরও বলেন, ‘আমরা বিগত দিনগুলোর জন্য লজ্জিত নই। আর সামনের দিনগুলোর জন্য নিরাশও নই।’ শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘বন্ধুরা! আমি বাধ্য হয়ে আদেশ দিচ্ছি, আপনারা হিজরতে বের হয়ে যান।’ এরপর আলবদর সদস্যরা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান।

No comments:

Post a Comment

ইন্টারনেটের ভর কত?

 আমরা যে ইন্টারনেট ব্যবহার করি তার ভর মাত্র ৫০ গ্রাম!? আমরা প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করি, কিন্তু কখনও কি ভেবেছি—এর আসল ভর কত? প্রায় ১৪ বছর...