পিছিয়ে যাচ্ছে ঘুম: রিভেঞ্জ বেডটাইম প্রোক্রাস্টিনেশনের যতকথা
আপনি কি রাত জেগে ইউটিউব স্ক্রল করেন? অথবা ঠিক শোবার আগেই 'আর একটা এপিসোড' বলে সিরিজ দেখা শুরু করেন? ঘুম আসলেও বারবার ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেন—"আর মাত্র দশ মিনিট!" কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই দশ মিনিটই রাতের ঘুম চুরি করে নেয়। যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে আপনি হয়তো ‘রিভেঞ্জ বেডটাইম প্রোক্রাস্টিনেশন’-এর শিকার!।
রিভেঞ্জ বেডটাইম প্রোক্রাস্টিনেশন কী?
রিভেঞ্জ বেডটাইম প্রোক্রাস্টিনেশন বলতে বোঝায় এমন একটি অভ্যাস যেখানে মানুষ বিনোদন বা অবসর সময় কাটানোর জন্য ঘুমের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করে। এটি মূলত আমাদের অবচেতন মনের এক একধরনের "প্রতিশোধ"—যেখানে ক্লান্তি সত্ত্বেও মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে ঘুম পিছিয়ে দেয়, শুধুমাত্র নিজের জন্য একটু ‘Personal Time’ বের করার আশায়।
গবেষকদের মতে, ২০১৪ সালে ডাচ জনগোষ্ঠীর উপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ কম, তারা ঘুমের সময় পেছাতে বেশি অভ্যস্ত।
২০১৪ সালে নেদারল্যান্ডসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুম পিছিয়ে দেওয়ার মূল কারণ হলো আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব। যারা দিনের কাজকর্মে নিজের ইচ্ছাকে দমাতে পারেন না, রাতেও তারা একই সমস্যায় ভোগেন। যেমন: অফিসের প্রজেক্ট জমা দেওয়ার শেষ মুহূর্তে ফেসবুক চেক করা, কিংবা রাত ১২টায় উঠে গিয়ে নেটফ্লিক্সের নতুন সিরিজ খোঁজা। গবেষকদের মতে, এটা ঘুমের প্রতি কোনো অনীহা নয়, বরং নিজের জন্য সময় বের করার তীব্র মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। যারা এটা করে, তারা জানে যে এটি ক্ষতিকর, তবুও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
কোভিড-১৯ মহামারির পর এই সমস্যা ৪০% বেড়েছে। ২০২১ সালের এক গবেষণা বলছে, বোরডম বা একঘেয়েমিও মানুষকে ঘুমের সময় দেরি করাতে বাধ্য করে। দিনের নিষ্ক্রিয়তা মনকে অস্থির করে তোলে, আর অমনোযোগিতা বাড়ায়। ফলে ঘুমানোর সময় হলেও আমরা যেকোনো কাজে ব্যস্ত থাকতে চাই—এমনকি তা যদি শুধু ওয়ালপেপার বদলানোর মতো নিষ্পাপ কাজও হয়!
বেডটাইম প্রোক্রাস্টিনেশন বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। ২০১৮ সালে ১৯ জনের উপর করা গবেষণা থেকে বেডটাইম প্রোক্রাস্টিনেশনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
সচেতন প্রোক্রাস্টিনেশন: কিছু মানুষ মনে করে তারা সারাদিন এত বেশি পরিশ্রম করেছে যে, তারা আরও একটু অবসর পাওয়ার অধিকার রাখে। তাই তারা ইচ্ছাকৃতভাবে রাত জাগে।
অবচেতন প্রোক্রাস্টিনেশন: অনেক সময় মানুষ সময়ের হিসাবই রাখতে পারে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করতে করতে বা টিভি দেখতে দেখতে কখন যে গভীর রাত হয়ে যায়, তা বুঝতেই পারে না।
কৌশলগত বিলম্ব: কিছু মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে দেরিতে শুতে যায়, যাতে ঘুমের আগে বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে ও সহজে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। গবেষকরা বলছেন, এটি অনিদ্রার লক্ষণ হতে পারে।
কীভাবে বুঝবেন আপনি ভুক্তভোগী?
- প্রতি রাতেই ঘুম কম হচ্ছে।
- জাগার কোনো যুক্তি নেই তারপরও জাগছেন(অসুস্থ নেই, কাজ নেই, শুধুই মজা আর মজা!)।
- ঘুম কমার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানার পরেও রুটিন বদলাতে অনিচ্ছা।
মজার বিষয় হলো, যাদের মুঠোফোনের প্রতি আসক্তি বেশি, তাদের মধ্যেই এই অভ্যাস প্রকট। ফোনের নোটিফিকেশন, অনির্দিষ্টকালের জন্য স্ক্রল—এগুলোই ঘুমের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।
প্রিয় বন্ধুরা "বেডটাইম প্রোক্রাস্টিনেশন আসলে স্বাধীনতার ভুল ব্যাখ্যা।" শরীর যখন ঘুমের সংকেত দেয়, তখন তাকে উপেক্ষা করলে পরের দিনের কর্মশক্তি আরো কমে যায়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আনন্দবোধ কমে যায়। এটা চলতে থাকলে একসময় একটা মানসিক চক্রের জন্ম হয়। যার ফলে বেডটাইম প্রোক্রাস্টিনেশন থেকে বেরিয়ে আসতে কষ্ট হয়।
সমাধানের পথ কী?
- রাত ১০টার পর মুঠোফোনের ব্যবহার বন্ধ করা।
- দিনেবেলা কাজের ফাঁকে ছোট ছোট বিরতি নেওয়া, যাতে রাতে "personal time" বের করার তাগিদ কমে।
- ঘুমানোর আগে বই পড়া বা মেডিটেশনের মতো নিষ্ক্রিয় কিছু অভ্যাস গড়ে তোলা।
মূল কথা হলো, আমাদের মনে রাখতে হবে: ঘুম কোনো বিলাসিতা নয়, বরং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার মূলভিত্তি। রাত জেগে যে সময়টুকু আমরা "এনজয় করি", তা আসলে পরের দিনের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে। তাই অবচেতন মনের প্রতিশোধ নয়, নিয়মিত ঘুমই হোক নিজের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসার প্রকাশ।
-আল আমিন তোফায়েল
No comments:
Post a Comment